OrdinaryITPostAd

দুর্নীতিমুক্ত সুশাসন: রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সাফল্য ও সিঙ্গাপুরের মডেল থেকে বাংলাদেশের শিক্ষা

লুন্ঠিত সম্ভাবনা পুনরুদ্ধার: দুর্নীতি থেকে মুক্তির অর্থনৈতিক প্রতিচ্ছবি

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় পরিবর্তন গভীরভাবে বিশ্লেষণে বাধ্য করে। গত ১৬ মাসের স্বল্প সময়ের ব্যবধানে দেশের চারটি প্রধান রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক কেন্দ্রে—রেল, বিমান, স্যাটেলাইট এবং বন্দর—যে আর্থিক ও পরিচালনগত বিপ্লব পরিলক্ষিত হয়েছে, তা দীর্ঘকাল ধরে চলমান একটি মৌলিক বিতর্কের নিষ্পত্তি করে। কেন্দ্রীয় থিসিসটি হলো: এই খাতগুলোতে বছরের পর বছর ধরে প্রদর্শিত 'লোকসান' প্রকৃতপক্ষে প্রশাসনিক অদক্ষতা বা অর্থনৈতিক ব্যর্থতা ছিল না, বরং তা ছিল রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক মাফিয়া চক্রের দ্বারা পরিচালিত ব্যাপক দুর্নীতির একটি কৌশলগত আবরণ। দুর্নীতি দমনের প্রাথমিক বা লক্ষ্যভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণে রাষ্ট্রের লুন্ঠিত অর্থনৈতিক সম্ভাবনা দ্রুত পুনরুদ্ধার হয়েছে। ঐতিহাসিকভাবেই জনগণের মধ্যে একটি বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে সরকারি আমলা ও ক্ষমতাবান নেতারা জনগণের পকেট কেটে চলেছে—ট্যাক্স বাড়িয়ে দেওয়া, ভাড়া বৃদ্ধি করা, এবং উল্টো রাষ্ট্রীয় কোষাগারে লোকসান দেখিয়ে জনগণকে বঞ্চিত করা। এই ধারণাকে সাম্প্রতিক আর্থিক প্রতিবেদনগুলো তথ্য-প্রমাণ দ্বারা সমর্থন করেছে। বাংলাদেশ রেলওয়ে যেখানে বিগত বছরগুলোতে আড়াই গুণ লোকসান দেখাতো , সেখানে মাত্র ১৬ মাসে ১১৮ কোটি টাকা লাভ অর্জন করেছে। অন্যদিকে, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স তার ৫৫ বছরের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রেকর্ড মুনাফা অর্জন করেছে, যা দুর্নীতি দমনের মাধ্যমে রাজস্ব প্রবাহকে ফিরিয়ে আনার এক শক্তিশালী দৃষ্টান্ত ।
Corruption-free good governance: Financial success of state institutions and lessons for Bangladesh from the Singapore model
এই প্রতিবেদনটি শুধু এই অভাবনীয় আর্থিক সাফল্যের তথ্যগুলো যাচাই করে না, বরং এই সাফল্যকে প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন ও দুর্নীতি দমনের বৈশ্বিক মডেল, বিশেষত সিঙ্গাপুরের 'জিরো টলারেন্স' নীতি এবং চীনের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির মডেলের আলোকে বিচার করে। লক্ষ্য হলো, কীভাবে কঠোর এবং নিরপেক্ষ দুর্নীতি দমন ব্যবস্থার মাধ্যমে বাংলাদেশ মাত্র এক দশকের মধ্যে দ্রুত উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছানোর চ্যালেঞ্জ বাস্তবায়ন করতে পারে, তার একটি সুনির্দিষ্ট রূপরেখা তৈরি করা। সুশাসন ছাড়া কোনো দেশের টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয় , এবং এই সাফল্য প্রমাণ করে যে সুশাসনের প্রাথমিক স্তরগুলো কার্যকর হলেই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দ্রুতগতিতে ফিরে আসে।

রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ঐতিহাসিক মোড় পরিবর্তন: দুর্নীতির আড়াল থেকে লাভের আলো

সাম্প্রতিক আর্থিক সাফল্য প্রমাণ করেছে যে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এন্টারপ্রাইজ (SOE)-এর দুর্বল আর্থিক কর্মক্ষমতা মূলত প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা এবং দুর্নীতিগ্রস্ত সিন্ডিকেটগুলোর ফল ছিল। একটি স্বল্পমেয়াদী প্রশাসনিক পরিবর্তন কীভাবে অর্থনীতির গতিপথ পাল্টে দিতে পারে, তা এই চারটি প্রতিষ্ঠানের মোড় পরিবর্তনের মাধ্যমে স্পষ্টভাবে বোঝা যায়।

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স: রেকর্ড মুনাফা এবং সিন্ডিকেট দমনের ফল

রাষ্ট্রায়ত্ত উড়োজাহাজ সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স বিদায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৯৩৭ কোটি টাকা অনিরীক্ষিত মুনাফা অর্জনের তথ্য দিয়েছে। এটি সংস্থাটির প্রতিষ্ঠার ৫৫ বছরের ইতিহাসে সর্বোচ্চ মুনাফার রেকর্ড। এর আগে বিমানের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জিত হয়েছিল ২০২১-২২ অর্থবছরে, যার পরিমাণ ছিল ৪৪০ কোটি টাকা । অর্থাৎ, মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে মুনাফা প্রায় দ্বিগুণ (১০০% এর বেশি) হয়েছে। এই অর্থবছরে কোম্পানির মোট আয় দাঁড়িয়েছে ১১,৬৩১ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। সংস্থাটি একই সময়ে ৩৪ লাখ যাত্রী পরিবহন করেছে এবং কেবিন ফ্যাক্টর ৮২ শতাংশে উন্নীত করেছে।এই বিশাল আর্থিক সাফল্যের পিছনে রয়েছে প্রশাসনিক কঠোরতা এবং দুর্নীতিগ্রস্ত সিন্ডিকেটগুলোর উৎখাত। সরকারের উদ্যোগে আকাশপথের টিকিটের উচ্চমূল্য কমাতে ১০ দফা নির্দেশনা জারি করা হয়, যার ফলস্বরূপ কিছু রুটে টিকিটের দাম ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে আনা সম্ভব হয় । সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ছিল দুর্নীতি অপসারণ: পাসপোর্ট বিবরণী ছাড়া টিকিট বুকিং বা গ্রুপ বুকিংয়ের নামে টিকিট ব্লক করার পদ্ধতি বাতিল করা হয় । এই পদ্ধতিটি অতীতে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট তৈরি করত, যারা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করত।

সাধারণত, যখন কোনো সেবার দাম কমানো হয়, তখন মুনাফা কমে যাওয়ার কথা। কিন্তু বিমানের ক্ষেত্রে টিকিটের দাম কমা সত্ত্বেও মুনাফা রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় এটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় যে দুর্নীতিগ্রস্ত সিন্ডিকেটগুলো পূর্বে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের যে আয় লুণ্ঠন করে নিজেদের পকেটে নিচ্ছিল—যাকে অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে 'রাজস্ব লুণ্ঠন' (Revenue Leakage) বলা হয়—সেই রাজস্ব এখন কঠোর প্রশাসনিক নজরদারির ফলে সরাসরি বিমানের কোষাগারে ফিরে এসেছে। এই সাফল্য পরিচালন অদক্ষতা দূর করার চেয়ে সিন্ডিকেট-চালিত রাজস্ব লুণ্ঠন বন্ধ করার ফল, যা জাতীয় রাজস্বকে লুণ্ঠনকারীদের পকেট থেকে রাষ্ট্রের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে।

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের আর্থিক প্রবৃদ্ধি (তুলনামূলক)

বিবরণ: মোট মুনাফা (কোটি টাকা)

  • ২০২১-২২ অর্থবছর: ৪৪০.০০
  • ২০২৪-২৫ অর্থবছর (অনিরীক্ষিত): ৯৩৭.০০
  • পরিবর্তন: +১১৩% (প্রায়)

বিবরণ: মোট আয় (কোটি টাকা)

  • ২০২১-২২ অর্থবছর: উল্লেখ নেই
  • ২০২৪-২৫ অর্থবছর (অনিরীক্ষিত): ১১,৬৩১.৩৭
  • পরিবর্তন: --

বিবরণ: কেবিন ফ্যাক্টর

  • ২০২১-২২ অর্থবছর: উল্লেখ নেই
  • ২০২৪-২৫ অর্থবছর (অনিরীক্ষিত): ৮২%
  • পরিবর্তন: উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি

বাংলাদেশ রেলওয়ে ও বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১: লোকসানের চক্র ভাঙা

রেলওয়ে এবং বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১-এর আর্থিক পারফরম্যান্সে একই ধরনের ইতিবাচক মোড় লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশ রেলওয়েতে বিগত বছরগুলোতে লোকসান দেখানোর প্রবণতা ছিল, যেখানে ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী আয়ের তুলনায় ব্যয় ছিল প্রায় আড়াই গুণ (২.৫ ব্যয় করে ১ আয়) । কিন্তু মাত্র ১৬ মাস সময়ের মধ্যে রেলওয়ে লাভ দেখিয়েছে ১১৮ কোটি টাকা। অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে, রেলওয়ের মতো একটি অবকাঠামো-ভারী প্রতিষ্ঠানে এত দ্রুত লোকসান থেকে লাভে আসা অসম্ভব, যদি না খরচের চ্যানেলগুলোতে থাকা ব্যাপক দুর্নীতি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। অতীতে লোকসানের মূল কারণ ছিল অকার্যকর প্রকল্প বাস্তবায়ন, অতিরিক্ত মূল্যে সরঞ্জাম ক্রয়, এবং রক্ষণাবেক্ষণ চুক্তিতে কমিশনভিত্তিক ব্যাপক দুর্নীতি। এই সাফল্য ইঙ্গিত দেয় যে রেলওয়ের অভ্যন্তরীণ প্রশাসনের কিছু অংশে, বিশেষত ব্যয় ব্যবস্থাপনা, ক্রয় প্রক্রিয়া এবং চুক্তি সম্পাদনে বড় ধরনের শুদ্ধি অভিযান চালানো হয়েছে, যা অপচয় রোধ করে লোকসানের ধারাকে উল্টে দিয়েছে।

এদিকে, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ (বিএস-১) উৎক্ষেপণের প্রায় ৬ বছর পর (২০১৮ সালের মে মাসে উৎক্ষেপিত) ৩৮ কোটি ৩৫ লাখ টাকা লাভ দেখছে [Query]। বিএস-১ দেশের বেসরকারি সব টেলিভিশন চ্যানেলের সম্প্রচার কার্যক্রমে সহায়তা করছে এবং বছরে প্রায় দেড়শ কোটি টাকা আয় করছে । ২,৯০২ কোটি টাকা ব্যয়ে নিজস্ব স্যাটেলাইটের মালিক হওয়া বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় প্রকল্প ছিল , এবং এর নিজস্ব পরিচালন সক্ষমতা অর্জন এবং লাভজনক হওয়া উচ্চাকাঙ্ক্ষী রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগের সফল আর্থিক মোড় নির্দেশ করে।

চট্টগ্রাম বন্দর: লজিস্টিকস বিপ্লব এবং বাণিজ্যের সুবিধা

দেশের বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু চট্টগ্রাম বন্দরেও দ্রুত প্রশাসনিক সংস্কারের ফল দেখা গেছে। ব্যবহারকারীর প্রশ্ন অনুযায়ী, আগে দিনের পর দিন পণ্য আটকা পড়ে থাকতো, কিন্তু এখন জাহাজ টার্নঅ্যারাউন্ড সময় নাটকীয়ভাবে কমে ৫ দিন থেকে মাত্র ২ দিনে নেমে এসেছে । এই দক্ষতা বৃদ্ধি প্রতিদিন প্রতি জাহাজে $১৫,০০০ থেকে $২০,০০০ ডলার ডেমারেজ বিল সাশ্রয় করছে । এই উন্নতি সরাসরি ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যয় কমায় এবং দেশের লজিস্টিকস খাতকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে সাহায্য করে। বন্দরের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির সাথে সাথে কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়েও রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। ২০২৪ সালে কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ে ৭.৪% বৃদ্ধি ঘটেছে (মোট ৩.২৭৬ মিলিয়ন TEUs), যা বন্দরের ইতিহাসে একটি রেকর্ড । সেপ্টেম্বর ২০২৪-এ গড় কন্টেইনার ডেল টাইম ৯.৩ দিনে নেমে এসেছে, যা এক মাসের ব্যবধানে ৩.৪ দিনের উন্নতি ।

তবে, এই অর্জনের গভীরে একটি গুরুতর প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা পরিলক্ষিত হয়। বন্দরের অপারেশনাল দক্ষতা দ্রুত বাড়লেও, কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সে এখনো বিলম্বের সমস্যা বিদ্যমান । যখন বন্দরের ডকে ঘুষ নেওয়া কঠিন হয়, তখন সেই অবৈধ কার্যক্রমগুলো কাস্টমস বা ডকুমেন্টেশন প্রক্রিয়ায় স্থানান্তরিত হতে পারে, যেখানে ডিসক্রিশনারি ক্ষমতা বেশি। এটি প্রমাণ করে যে দুর্নীতি স্থায়ীভাবে নির্মূল না হলে তা সুযোগ অনুযায়ী এক দুর্বল প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য দুর্বল প্রতিষ্ঠানে স্থানান্তরিত হয়। এই সমস্যা সমাধানের জন্য সিঙ্গাপুরের মতো পোর্ট কমিউনিটি সিস্টেমের মাধ্যমে ডিজিটাল স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা আবশ্যক, যা কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স প্রক্রিয়াকে সুসংগঠিত, স্বচ্ছ এবং দুর্নীতিমুক্ত করতে পারে ।

'লোকসান'-এর আড়ালে দুর্নীতি: অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা

দুর্নীতির স্বরূপ ও রাষ্ট্রের কাঠামোতে এর প্রভাব

দুর্নীতি কেবল আর্থিক লুটপাট নয়, এটি একটি প্রাতিষ্ঠানিক রোগ যা সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করে । দুর্নীতি জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণের অধিকারকে সীমিত করে এবং তাদের মুক্ত ও স্বাধীনভাবে জীবনযাপনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় । রাজনৈতিক, প্রশাসনিক বা সামাজিক ক্ষমতা ব্যবহার করে অবৈধ সুযোগ গ্রহণ, সম্পদ জবরদখল করা, খাদ্যে ভেজাল দেওয়া, এবং আইন ফাঁকি দিয়ে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করা—এ সবই দুর্নীতির অন্তর্ভুক্ত ।

অর্থনীতিবিদ ড্যারন আসেমোগলু, সিন জনসন ও জেমস এ রবিনসনের গবেষণা দেখায় যে, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে দুর্বল 'এক্সট্রাক্টিভ' প্রতিষ্ঠানগুলো (যা সমাজের সম্পদ একটি সংকীর্ণ গোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত করে) কীভাবে বাধা সৃষ্টি করে । বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, দুর্নীতিবাজ এমপি, মন্ত্রী এবং সরকারি কর্তাদের দ্বারা পরিচালিত পূর্বের 'লোকসানের আবরণ' ছিল এই এক্সট্রাক্টিভ প্রাতিষ্ঠানিকতার চূড়ান্ত উদাহরণ। তারা রাজস্ব চুরি করার পর সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে জনগণের উপর ট্যাক্স ও ভাড়ার বোঝা চাপাতো, যা নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনযাত্রাকে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত করে।

সুশাসনের পথে চ্যালেঞ্জ: সিপিআই সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান এবং অসঙ্গতি

যদিও নির্দিষ্ট রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে দ্রুত আর্থিক সাফল্য অর্জিত হয়েছে, বাংলাদেশের সামগ্রিক দুর্নীতি ধারণা সূচক (CPI) ২০২৪ এর চিত্রটি গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি করে। বার্লিনভিত্তিক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) কর্তৃক প্রকাশিত CPI 2024 অনুযায়ী, বাংলাদেশের স্কোর ২৩, যা গত ১৩ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন । বাংলাদেশ ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৫১তম স্থানে রয়েছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম (কেবল আফগানিস্তানের চেয়ে ভালো) । এই নিম্ন স্কোর সামগ্রিক সুশাসন, জবাবদিহিতা এবং আইনের শাসনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর দুর্বলতাকে স্পষ্ট করে। টিআইবি এই পরিস্থিতিকে 'স্বৈরাচারী ক্লিপটোক্র্যাটিক শাসন' দ্বারা উৎসাহিত দুর্নীতি হিসেবে চিহ্নিত করেছে ।

এই পরিস্থিতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অসঙ্গতি উঠে আসে: নির্দিষ্ট রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানে আর্থিক লাভ হলেও, জাতীয় সিপিআই স্কোর কেন নিম্নগামী হচ্ছে? এই অসঙ্গতি ব্যাখ্যা করে যে, সরকারের কিছু প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত (যেমন টিকিট সিন্ডিকেট ভাঙা) অর্থনৈতিক খাতে লক্ষ্যভিত্তিক দক্ষতা বৃদ্ধি করতে পারে, কিন্তু সিপিআই সূচক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতা, এবং সাধারণ জনগণের অভিজ্ঞতা থেকে প্রাপ্ত পদ্ধতিগত দুর্নীতি পরিমাপ করে। SOE-এর আর্থিক লাভ মূলত প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক দক্ষতা বৃদ্ধির ফল, যেখানে উচ্চপর্যায়ের আর্থিক লিকেজ বন্ধ করা হয়েছে। কিন্তু জাতীয় বিচার ব্যবস্থা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং রাজনৈতিক প্রভাবে দুর্নীতি অপ্রতিরোধ্য থাকলে এবং ক্ষমতাবানদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত না হলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা হয় না। তাই, দুর্নীতিমুক্ত দেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নে কেবল অর্থনৈতিক লাভ দেখলেই চলবে না, বরং প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে এবং বিচার বিভাগের সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করতে হবে।

বাংলাদেশের দুর্নীতি সূচক (CPI) ও বৈশ্বিক অবস্থান (২০২৩-২০২৪)

বছর : ২০২৩
  • স্কোর (০-১০০): ২৪
  • বৈশ্বিক অবস্থান (১৮০ দেশের মধ্যে): ১৪৯
  • পরিবর্তন: --
  • গুরুত্বপূর্ণ তথ্য :দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ
বছর : ২০২৪
  • স্কোর (০-১০০): ২৩
  • বৈশ্বিক অবস্থান (১৮০ দেশের মধ্যে): ১৫১
  • পরিবর্তন: ১ স্কোর, ২ স্থান পতন
  • গুরুত্বপূর্ণ তথ্য : গত ১৩ বছরে সর্বনিম্ন স্কোর

দুর্নীতি দমনে বৈশ্বিক দৃষ্টান্ত: কঠোরতা, প্রাতিষ্ঠানিকতা ও বাংলাদেশের জন্য কৌশল

বাংলাদেশের মতো দেশ, যা দ্রুত উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষা করে, তার জন্য সিঙ্গাপুর ও চীনের মতো দেশগুলোর দুর্নীতি দমন মডেল থেকে শিক্ষা নেওয়া অত্যাবশ্যক। এই মডেলগুলো প্রমাণ করে যে দুর্নীতি দমনে দ্বিধাগ্রস্ত পদক্ষেপের কোনো স্থান নেই, প্রয়োজন আমূল সংস্কার।

সিঙ্গাপুরের মডেল: রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং 'জিরো টলারেন্স' নীতি

সিঙ্গাপুরের প্রতিষ্ঠাতা প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান ইউ ১৯৫৯ সালে সরকার গঠন করার পরই দুর্নীতিকে জাতীয় উন্নয়নের প্রধান বাধা হিসেবে চিহ্নিত করেন । তিনি দেশ জুড়ে একটি 'জিরো টলারেন্স' নীতি প্রতিষ্ঠা করেন, যার মূল ভিত্তি ছিল দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছা। এর ফলস্বরূপ, দুর্নীতিমুক্ত সংস্কৃতি সিঙ্গাপুরের সমাজ ও প্রশাসনে স্থায়ীভাবে গেঁথে যায় । সিঙ্গাপুরের সাফল্যের মূলে রয়েছে দুর্নীতি দমন ব্যুরো (CPIB)-এর অভূতপূর্ব সক্ষমতা। শক্তিশালী আইন, যেমন 'Prevention of Corruption Act' (PCA), CPIB-কে সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতের দুর্নীতি তদন্ত করার ক্ষমতা দেয় । সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো আইনি প্রয়োগের নিরপেক্ষতা: পদমর্যাদা বা রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নির্বিশেষে কাউকেই আইনের ঊর্ধ্বে রাখা হয় না ('নো ওয়ান ইজ এক্সাম্পটেড') । CPIB দ্রুত এবং কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করে, যা দুর্নীতিকে উচ্চ-ঝুঁকির, নিম্ন-পুরস্কারের কার্যকলাপে পরিণত করে ।

এছাড়াও, লি কুয়ান ইউ একটি বাস্তববাদী কৌশল গ্রহণ করেন: সৎ ও দক্ষ কর্মকর্তাদের ধরে রাখতে এবং প্রলোভন থেকে দূরে রাখতে তিনি সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের জন্য বেসরকারি খাতের সমতুল্য উচ্চ বেতন কাঠামো নির্ধারণ করেন । এই পদক্ষেপ নিশ্চিত করে যে প্রশাসনকে পরিচালনার জন্য সেরা মেধা নিয়োগ করা হয় এবং আর্থিক প্রলোভনের ঝুঁকি হ্রাস পায়।

চীন মডেল: চরম শাস্তি এবং চূড়ান্ত প্রতিরোধ

ব্যবহারকারীর মতে, মৃদু শাস্তির নীতি (শোকজ বা বদলি) দুর্নীতিবাজদের থামানোর জন্য যথেষ্ট নয়। চীন তার দুর্নীতি দমন নীতিতে চরম শাস্তিকে একটি প্রধান প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে ব্যবহার করে। সম্প্রতি, চীন হুয়ারং ইন্টারন্যাশনাল হোল্ডিংস-এর সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তা বাই তিয়ানহুইকে ১৫৭ মিলিয়ন ডলার ঘুষ গ্রহণের দায়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে (ডিসেম্বর ২০২৫) । চীনের সুপ্রিম পিপলস কোর্ট (এসপিসি) রায় দেয় যে তার অপরাধ ছিল 'অত্যন্ত গুরুতর' এবং রাষ্ট্রের এবং জনগণের স্বার্থের জন্য 'বিরাট ক্ষতি' সাধন করেছে ।

এই দৃষ্টান্তমূলক কঠোর শাস্তি একটি সুস্পষ্ট বার্তা দেয়: যারা ব্যাপক দুর্নীতিতে লিপ্ত হবে, তাদের কোনোভাবে ছাড় দেওয়া হবে না। বাংলাদেশে বর্তমানে দুর্নীতিবাজরা আইনি জটিলতা বা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে পার পেয়ে যাওয়ার নিশ্চয়তা পায়। কিন্তু চীন বা অন্যান্য কঠোর শাসন ব্যবস্থায়, এই দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ দুর্নীতিকে এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে যায় যেখানে লুণ্ঠনকারীরা জানে দুর্নীতি করলে তাদের 'পৃথিবী থেকে নাই করে দিবে', যা চূড়ান্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে।

বাংলাদেশের জন্য একটি সমন্বিত কৌশল: প্রতিষ্ঠান এবং প্রতিরোধ

বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজন সিঙ্গাপুর এবং চীনের মডেলের উপাদানের সমন্বয়। প্রথমত, সিঙ্গাপুরের মতো শক্তিশালী, নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান (বিচার বিভাগ, ACC) এবং দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, পদ্ধতিগত ও বৃহৎ আকারের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে দ্রুত এবং দৃষ্টান্তমূলক কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশের দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোরেরা জানে যে তারা জেলে গেলেও আইনজীবীকে টাকা দিলে সত্যকে মিথ্যা বানিয়ে আবার চাকরিতে ফিরতে পারে। এই সংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটাতে হলে আমূল সংস্কার এবং বড় দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে এমন শাস্তির প্রয়োজন, যা দুর্নীতিকে একটি অগ্রহণযোগ্য, উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবে।

সুশাসন ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা: ১০ বছরের উন্নত বাংলাদেশের রূপরেখা

অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিরোধক দুর্নীতিকে নির্মূল করে বাংলাদেশ যদি দ্রুত উন্নয়নের পথে হাঁটতে চায়, তবে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং আইনের শাসনকে নিরপেক্ষ করতে হবে।

আইনের শাসন ও বিচার ব্যবস্থার সার্বভৌমত্ব

বাংলাদেশের মূল সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বিচার ব্যবস্থার সার্বভৌমত্বের অভাব। একজন নাগরিকের অভিযোগ, বিচার বিভাগ নামে মাত্র বিদ্যমান এবং 'ক্ষমতা যেদিকে রায় যাচ্ছে সেদিকে'। এই পরিস্থিতি পরিবর্তন করতে হলে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ এবং রাজনৈতিক প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করতে হবে। নিরপেক্ষ আইন ও বিচার ব্যবস্থা ছাড়া সুশাসন প্রতিষ্ঠার কোনো দাবিই গ্রহণযোগ্য নয়।   
জনপ্রতিনিধিদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। এমপি, মন্ত্রী এবং সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সম্পদের স্বচ্ছ ও উন্মুক্ত ঘোষণা বাধ্যতামূলক করা উচিত। রাজনৈতিক মাফিয়াদের পকেটে যে জনগণের অর্থ যায়, তা বন্ধ করতে হবে [Query]।

আমলাতন্ত্রে সততা ও সক্ষমতা

সিঙ্গাপুরের শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশে মেধা এবং সততার ভিত্তিতে সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়োগ ও পদোন্নতি নিশ্চিত করতে হবে। সরকারি কর্মকর্তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় এবং আয়ের মধ্যে অসামঞ্জস্য (যেমন, ২০ হাজার টাকার দামের চাকরি করে ৫/১০ তলা বাড়ি বানানো) খুঁজে বের করার জন্য শক্তিশালী নজরদারি এবং দ্রুত তদন্ত পদ্ধতি চালু করতে হবে [Query]। CPIB-এর মতো একটি স্বাধীন এবং শক্তিশালী সংস্থা দুর্নীতি তদন্তের ক্ষেত্রে কোনো প্রকার রাজনৈতিক চাপ উপেক্ষা করে কাজ করবে, এমন প্রাতিষ্ঠানিক পরিবেশ তৈরি করা অপরিহার্য।

১০ বছরে উন্নতির চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাবনা

সাম্প্রতিক SOE-এর সাফল্য দেখিয়েছে যে প্রাতিষ্ঠানিক বাধা দূর হলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা কতটা শক্তিশালী। অর্থনীতিবিদদের মতবাদ অনুযায়ী, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সৎ প্রতিষ্ঠান অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিশ্চিত করে । যদি দুর্নীতি, যা বর্তমানে সিপিআই স্কোর অনুযায়ী ১৩ বছরের সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে , তা বন্ধ করা সম্ভব হয়, তবে বাংলাদেশের উন্নয়নের গতি দ্রুত বাড়তে পারে। ব্যবহারকারীর চ্যালেঞ্জটি অত্যন্ত বাস্তবসম্মত: যদি শুধুমাত্র দুর্নীতি বন্ধ করা যায়, তবে মাত্র ১০ বছরের ভিতরে বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ার থেকেও বেশি উন্নত হয়ে যেতে পারে।

এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রয়োজন শুধু সুশাসন, নিরপেক্ষ আইনের শাসন এবং দুর্নীতিমুক্ত একটি দেশ। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য, রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়ে দুর্নীতি দমনে 'জিরো টলারেন্স' নীতি কঠোরভাবে প্রয়োগ করা অপরিহার্য।

শেষকথা: ১০ বছরে সিঙ্গাপুরে পৌঁছানোর চ্যালেঞ্জ এবং প্রতিজ্ঞা

বাংলাদেশের জনগণ, যারা ১৯৭১ সালে রক্ত দিয়েছে একটি ন্যায় ও সমৃদ্ধ সমাজের জন্য, গত কয়েক দশকে প্রশাসনিক দুর্নীতি ও অব্যবস্থার কারণে তাদের সেই স্বপ্ন বহুলাংশে লুন্ঠিত হয়েছে। তবে গত ১৬ মাসের মধ্যে রেল, বিমান, স্যাটেলাইট এবং বন্দরের মতো খাতগুলোতে যে আর্থিক মোড় পরিবর্তন ঘটেছে, তা একটি মৌলিক সত্যকে প্রতিষ্ঠা করে: এ দেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা প্রচণ্ড শক্তিশালী; শুধুমাত্র দুর্নীতির বাঁধ ভেঙে দিলেই সেই সম্ভাবনা অবাধ স্রোতে বয়ে যেতে পারে। এই বিচ্ছিন্ন সাফল্যগুলোকে সামগ্রিক জাতীয় নীতিতে পরিণত করাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। টিআইবি-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি এখনো গভীরে প্রোথিত । যতক্ষণ না আইনের শাসন নিরপেক্ষ হচ্ছে, বিচার ব্যবস্থা স্বাধীন হচ্ছে, এবং দুর্নীতি দমন কমিশন ভয়-ভীতিহীনভাবে মন্ত্রী-এমপি-বড়কর্তাদের আইনের আওতায় আনতে পারছে, ততক্ষণ পর্যন্ত এই পরিবর্তন অস্থায়ী থাকবে। জনগণের আইন জনগণের না হলে এবং মিডিয়া ক্ষমতাসীনদের দালালি করলে সত্যিকারের সুশাসন সম্ভব নয়।

সিঙ্গাপুরের অভিজ্ঞতা আমাদের শেখায় যে, রাজনৈতিক সদিচ্ছা, শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ আইন প্রয়োগকারী সংস্থা (CPIB), এবং দক্ষ আমলাদের জন্য ন্যায্য পরিবেশ অপরিহার্য। চীন দেখিয়েছে, চূড়ান্ত প্রতিরোধের ভয় কিভাবে লুণ্ঠনকারীদের থামিয়ে দিতে পারে। বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজন এই দুই মডেলের উপাদানগুলোর একটি বাস্তবসম্মত সমন্বয়: সততার জন্য প্রণোদনা, জবাবদিহিতা এবং ব্যাপক লুণ্ঠনের জন্য চূড়ান্ত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। যদি দেশের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করা হয়, এবং জনগণের টাকা যারা চুরি করেছে, তাদের আইনের আওতায় এনে দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা যায়, তবে বাংলাদেশের উন্নয়ন বিশ্বের কাছে একটি বিস্ময়কর উদাহরণ হবে। খেটে খাওয়া কৃষক, মজুর এবং প্রবাসীদের আর ঠকানো উচিত নয়। তাদের একমাত্র চাওয়া—সুশাসন ও দুর্নীতিমুক্ত একটি দেশ।

কল টু এ্যাকশন (Call to Action)

দেশের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে 'জিরো টলারেন্স' নীতি গ্রহণ করুন; বড় বড় দুর্নীতিবাজদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করে রাষ্ট্রীয় কাঠামো সংস্কারের মাধ্যমে জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনুন এবং জাতীয় উন্নয়নের পথে প্রধান বাধা দুর্নীতিকে চিরতরে দূর করুন।

সচরাচর জিজ্ঞাসা (FAQ)

প্রশ্ন : ১. রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের দ্রুত লাভের পেছনে প্রধান কারণ কী?

  • উত্তর-প্রধান কারণ হলো দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট ও প্রশাসনিক লিকেজ বন্ধ করা। বিশেষত, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ক্ষেত্রে টিকেটিং সিন্ডিকেট ভাঙা এবং বন্দরের ক্ষেত্রে টার্নঅ্যারাউন্ড সময় নাটকীয়ভাবে হ্রাস করায় রাজস্ব বৃদ্ধি ও ব্যয় সাশ্রয় হয়েছে ।

প্রশ্ন : ২. বিমান টিকেটের দাম কমলেও কীভাবে রেকর্ড মুনাফা হলো?

  • উত্তর-টিকেটের দাম কমানো সত্ত্বেও রেকর্ড মুনাফা হয়েছে, কারণ প্রশাসনিক সংস্কারের মাধ্যমে এয়ারলাইন্সের টিকিট বুকিংয়ে ব্লক করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির দুর্নীতি বন্ধ করা হয়েছে। ফলে, রাজস্বের যে অংশটি মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে যেত, তা এখন সরাসরি বিমানের আয়ে যুক্ত হচ্ছে, যা রাজস্ব লুণ্ঠন রোধের প্রতিফলন ।

প্রশ্ন : ৩. বাংলাদেশ রেলওয়ের ১১৮ কোটি টাকা লাভ কতটা তাৎপর্যপূর্ণ?

  • উত্তর-এটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ঐতিহাসিকভাবে রেলওয়ে লোকসানের প্রতীক ছিল (খরচের তুলনায় আয়ের অনুপাত প্রায় ১:২.৫) । এই লাভ নির্দেশ করে যে রেলওয়ের অভ্যন্তরীণ পরিচালন ব্যয় এবং মালামাল ক্রয়/নিয়োগ সংক্রান্ত দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে, যার ফলে লোকসানের প্রবণতা উল্টে গেছে।

প্রশ্ন : ৪. সিপিআই সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান খারাপ হওয়া সত্ত্বেও আর্থিক সাফল্য কি সম্ভব?

  • উত্তর-হ্যাঁ। এটি এক ধরনের অসঙ্গতিপূর্ণ সাফল্য। সিপিআই দেশের সামগ্রিক প্রাতিষ্ঠানিক ও রাজনৈতিক দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে । SOE-এর আর্থিক সাফল্য এসেছে নির্দিষ্ট কিছু অর্থনৈতিক খাতে টার্গেটেড প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধি এবং উচ্চপর্যায়ের লিকেজ বন্ধ করার কারণে, কিন্তু আইনের শাসন বা বিচার ব্যবস্থার মতো মূল কাঠামোয় সুশাসন নিশ্চিত না হওয়ায় জাতীয় সিপিআই স্কোর নিম্নগামী হয়েছে।

প্রশ্ন : ৫. সিঙ্গাপুরের দুর্নীতি দমনের মূলমন্ত্র কী, যা বাংলাদেশের গ্রহণ করা উচিত?

  • উত্তর-সিঙ্গাপুরের মূলমন্ত্র হলো 'জিরো টলারেন্স' নীতি, যা দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছা, CPIB-এর মাধ্যমে নিরপেক্ষ আইন প্রয়োগ, এবং সৎ ও মেধাবী আমলাদের জন্য উচ্চ পারিশ্রমিক ও মেধাভিত্তিক পদ্ধতি । এই চারটি স্তম্ভই একসাথে দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন নিশ্চিত করে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

কাজীআরিফুল ডট কমে নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url