বাইকের চেইন স্মুথ করার উপায়- Chain Lube, Gear Oil নাকি Engine Oil? বিস্তারিত গাইডলাইন
আচ্ছা, সত্যি করে বলুন তো, শেষ কবে আপনার বাইকের চেইনের দিকে ভালো করে তাকিয়েছেন?
হ্যাঁ, আপনাকে জিজ্ঞেস করছি।
আমরা অনেকেই আছি যারা বাইকের ইঞ্জিন অয়েল চেঞ্জ করার ডেট ক্যালেন্ডারে দাগিয়ে রাখি, বাইক একটু ময়লা হলেই ধুয়ে চকচকে করে ফেলি। কিন্তু ওই যে পেছনের চাকার সাথে লেগে থাকা লোহার শিকলটা—যেটা আসলে ইঞ্জিনের সমস্ত শক্তি চাকায় পৌঁছে দিচ্ছে—তার কথা আমরা বেমালুম ভুলে যাই। যতক্ষণ না সে চিৎকার করে ওঠে। রাস্তায় চলতে চলতে হঠাৎ কানে আসে একটা বিরক্তিকর "ক্যাঁচ-ক্যাঁচ-ক্যাঁচ" শব্দ। গতি কমালে বাড়ে, বাড়ালে কমে। মেজাজটাই খারাপ হয়ে যায়, তাই না? একটা স্মুথ রাইডের ফিলিংসটাই মাটি। এই শব্দটা আসলে আপনার বাইকের কান্নার শব্দ। সে আপনাকে বলছে, "ভাই, আর পারছি না! একটু কিছু খেতে দাও, গলা শুকিয়ে গেছে!" বাইকের চেইন হলো বাইকের অন্যতম অবহেলিত কিন্তু সুপার ইম্পরট্যান্ট একটা পার্ট। আর এই চেইনকে ভালো রাখার একমাত্র উপায় হলো সঠিক লুব্রিকেশন বা পিচ্ছিল করা। এখন প্রশ্ন হলো, কী দিয়ে লুব্রিকেট করবেন? গ্যারেজের মেকানিক ভাই হয়তো বলবে, "আরে ভাই, পোড়া মবিল মাইরা দেন, কিচ্ছু হবে না।" পাশের বাসার অভিজ্ঞ বাইকার চাচা হয়তো বলবে, "গিয়ার অয়েল 90 নম্বরটা সেরা, ওটাই ব্যবহার করো।" আবার ইউটিউবের চকচকে ভিডিওতে দেখবেন নামীদামী ব্র্যান্ডের স্প্রে ক্যান—Chain Lube।
কনফিউশন! চূড়ান্ত কনফিউশন।
আমি নিজেও এই কনফিউশনের মধ্যে দিয়ে গেছি। বছরের পর বছর বাইক চালাতে গিয়ে ভুল জিনিস ব্যবহার করেছি, চেইন নষ্ট করেছি, তারপর ঠেকে শিখেছি। আজকের এই ব্লগে, আমরা সেই শেখা বিষয়গুলোই আপনাদের সাথে শেয়ার করব। আমরা ল্যাবরেটরির কঠিন ভাষায় কথা বলব না। একদম বন্ধুর মতো, চায়ের আড্ডায় যেভাবে কথা বলি, সেভাবে আলোচনা করব। ইঞ্জিন অয়েল, গিয়ার অয়েল, নাকি ডেডিকেটেড চেইন লুব—আসলে কোনটা আপনার বাইকের জন্য সেরা এবং কীভাবে লুব ব্যবহার করলে আপনার বাইক মাখনের মতো স্মুথ চলবে, সেটাই জানব। হ্যাঁ বন্ধু, কথা দিচ্ছি, আজকের আলোচনা তোমার বাইকের জীবন বদলে দেবে। শুধু গতি বাড়বে না, সেই ‘চিকন চিকন’ সাউন্ডে মুখে হাসি ফুটবে। তুমি কি কখনও গ্যারেজ থেকে বাইক বের করতেই ‘ক্র্যাং ক্র্যাং’ শব্দ শুনে বিরক্ত হয়েছ? অথবা হাইওয়ে রাইডে হঠাৎ মনে হয়েছে, বাইকটা যেন ঠিক মতো পাওয়ার ট্রান্সমিট করছে না? একটু ঝাঁকি লাগছে? সমস্যাটা খুব সম্ভবত চেইনের যত্নে। আমি নিজেও বহু বছর ভুগেছি। প্রথম বাইকটা কিনে কি ধুম করেই না চেইনে ইঞ্জিন অয়েল ছিটিয়েছি! মনে হচ্ছিল, “এটাতো তেলই, কাজ করবেই।” ফলাফল? কিছুদিন পরেই চেইন আর স্প্রকেট দেখে মনে হচ্ছিল বালির ডুন! কালো, আঠালো, বালি-ময় – এক কথায় ভয়ংকর। তারপরই ট্রায়াল আর এরর। চেইন লুব, গিয়ার অয়েল – সব টেস্ট। আজ যে জ্ঞানটা পেয়েছি, সেটা শেয়ার না করলেই নয়। কারণ, আমাদের ব্লগের উদ্দেশ্যই তো – নিজে জানা, অন্যকে জানানো।
এটা শুধু তেল ছিটানোর ব্যাপার নয়। এটা বাইকের সাথে তোমার সম্পর্কের ব্যাপার। সঠিক লুব্রিক্যান্টটি ঠিক যেমন আমাদের জয়েন্টগুলো মসৃণ রাখে, তেমনি তোমার বাইকের চেইন, স্প্রকেট, গিয়ারবক্সকেও রাখে প্রাণবন্ত। ভুল প্রোডাক্ট? দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি, আর্থিক ক্ষতি। তাই চলো, আজ একসাথে ডুব দেই Chain Lube, Gear Oil, আর Engine Oil-এর রহস্যময় জগতে। বের করি, কোনটা তোমার লৌহসঙ্গীর জন্য সেরা। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ – কিভাবে সঠিক চেইন লুব ব্যবহার করে তুমি তোমার বাইককে করবে বায়ুর মতো মসৃণ।
চলুন, শুরু করা যাক আমাদের "অপারেশন স্মুথ রাইড"।
চেইন লুব, গিয়ার অয়েল, নাকি ইঞ্জিন অয়েল – কোনটা কোথায়?
আমাদের প্রথম স্টপ – কনফিউশন জোন। তিনটাই তো তেল। তাহলে পার্থক্যটা কী? খুব সহজ ভাষায় বলি।
- ইঞ্জিন অয়েল (Engine Oil): এটার কাজ ইঞ্জিনের ভিতরে। ক্র্যাঙ্কশ্যাফট, পিস্টন, ক্যামশ্যাফট – এইসব পাগলাটে পার্টসগুলোর ঘর্ষণ কমায়, তাপ নিয়ন্ত্রণ করে, ঝাল পড়া অংশগুলো পরিষ্কার রাখে। এটা উচ্চ তাপমাত্রা আর প্রেশার সামলানোর জন্য তৈরি। কিন্তু! এর মানে এই না যে এটা চেইনের জন্য ভালো। চেইনে ইঞ্জিন অয়েল দিলে সেটা খুব পাতলা হয়ে বের হয়ে যায়, ধুলোবালি আটকে যায় সহজে, একটা আঠালো, ময়লার স্তর তৈরি করে। আমার মতো ভুল করো না যেন!
- গিয়ার অয়েল (Gear Oil):এটা পুরু। খুবই পুরু। এর কাজ গিয়ারবক্সের ভিতরের গিয়ারগুলোকে লুব্রিকেট করা, তাদের উপর যে প্রচন্ড চাপ আর শক্তি পড়ে, তা সহ্য করা। এটা সাধারণত EP (Extreme Pressure) গ্রেডের হয়। কিছু মানুষ পুরনো গিয়ার অয়েল চেইনে দেয়। ব্যাপারটা একদমই উচিত না। কারণ এর সান্দ্রতা (viscosity) অনেক বেশি। বাইকের চেইনে এটা জমে যায়, অতিরিক্ত পুরু স্তর তৈরি করে, যা সহজে বাইরের ধুলো-বালি, রাস্তার খুঁটে কণা আটকে ফেলে। ফলে চেইন আর স্প্রকেটের দ্রুত ক্ষয় হয়। তবে কিছু হেভি-ডিউটি, অফ-রোড এর জন্য বিশেষ গিয়ার অয়েল বেসড চেইন লুব পাওয়া যায়, কিন্তু সেটা সরাসরি গিয়ার অয়েল নয়।
- চেইন লুব (Chain Lube):এইটাই হিরো। এটা শুধুমাত্র চেইন আর স্প্রকেটের কথা মাথায় রেখে তৈরি। এর কাজ অনেকগুলো: ঘর্ষণ কমানো, জং প্রতিরোধ করা, অতিরিক্ত গরম হওয়া থেকে রক্ষা করা। এবং সবচেয়ে বড় ব্যাপার – এটা চেইনের পিন আর রোলার্সের ভিতর পর্যন্ত ঢুকে কাজ করে, বাইরের অংশটা শুধু রক্ষা করে না। এগুলো আবার নানা রকমের – ড্রাই লুব, ওয়েট লুব, সিরামিক বেসড, টেফলন বেসড। পরে বিস্তারিত বলছি।
চেইন লুবের রাজ্য: কোনটা কখন?
এখন আসি চেইন লুবের ভিতরের দুনিয়ায়। সবুজ সংকেত পেয়ে তুমি দৌড়ে গিয়ে যেকোনো একটা কিনে ফেলবে? থামো! জেনে নাও কোন লুব কোন অবস্থার জন্য।
- ড্রাই লুব্রিকেন্ট (Dry Lube) - এটা সাধারণত ওয়াক্স বা প্যারাফিন বেসড হয়। লাগানোর পর দ্রুত শুকিয়ে যায়, একটা শুষ্ক, মোমের মতো প্রলেপ দেয়। কখন ব্যবহার করবো? শুকনো, ধুলোবালি বেশি এমন রাস্তার জন্য। যেমন আমাদের ঢাকার রাস্তা, বা খুলনার ডাস্টি রোড। যেহেতু এটা শুষ্ক, তাই ধুলো কম আটকায়। চেইন থাকে অনেক পরিষ্কার।
- ওয়েট লুব্রিকেন্ট (Wet Lube)-এটা তেল বেসড, পুরু এবং আঠালো প্রকৃতির। দীর্ঘস্থায়ী। পানিতে ধোয়া যায় না সহজে। কখন ব্যবহার করবো? বর্ষাকালে, আর্দ্র আবহাওয়ায়, কিংবা যেখানে নিয়মিত বাইক ধুতে হয়। এটা চেইনকে ময়শ্চার আর জং থেকে নিরাপদ রাখে।
- সিরামিক বা টেফলন বেসড লুব-এগুলো হাই-এন্ড অপশন। সিরামিক বা টেফলন (PTFE) কণা চেইনের মেটাল-টু-মেটাল কন্টাক্ট কমিয়ে দেয় প্রচন্ডভাবে। অসাধারণ সুচালোতা (Smoothness) দেয়। তাপ সহ্য করার ক্ষমতাও ভালো।
সঠিক নিয়মে চেইন লুব দেয়া: স্টেপ বাই স্টেপ গাইড
জ্ঞান হলো, এবার কাজে লাগাই। শুধু স্প্রে করে ছিটিয়ে দিলেই হবে না। পদ্ধতিটা মানলে ফলটা পাবে অবিশ্বাস্য। প্রস্তুতি (তুমি যা যা প্রয়োজন):
- একটি ভালো কোয়ালিটির চেইন লুব (তোমার রাইডিং কন্ডিশন অনুযায়ী)।
- চেইন ক্লিনার বা কেরোসিন (আমি ব্যক্তিগতভাবে কেরোসিন পছন্দ করি, সস্তা ও কার্যকর)।
- কিছু রাগ বা পুরনো কাপড় (বেশি কিছু, এগুলো নোংরা হবে)।
- একটি টুথব্রাশ বা চেইন ব্রাশ (স্পেসিফিক)।
- গ্লভস (অপশনাল, কিন্তু হাত রক্ষা পাবে)।
- স্ট্যান্ড বা দাঁড় করানোর উপায় (বাইকটা সোজা থাকা চাই)।
কতদিন পর পর দেবো?
এটা নির্ভর করে তুমি কতটা রাইড করো, এবং কী অবস্থায় করো। সাধারণ নিয়ম:
- প্রতি ৩০০-৫০০ কিমি-তে একবার চেক করো। শুকনো দেখলে বা শব্দ হলে দিয়ে দাও।
- বৃষ্টিতে ভিজে গেলে বা বাইক খুব ভালোভাবে ধোয়ার পর, অবশ্যই নতুন করে লুব দেবে।
- অন্তত মাসে একবার দেয়াই ভালো প্র্যাকটিস, রাইডিং কম হলেও।
সিদ্ধান্ত: কোনটি সেরা?
দেখুন, সেরা বলে কোনো এক কথায় উত্তর নেই। এটি নির্ভর করে আপনি কী ধরনের বাইকার তার ওপর।
- যদি আপনি একদমই বাজেটে থাকেন এবং বাইকের লুকস নিয়ে খুব একটা মাথা না ঘামান, তবে গিয়ার অয়েল একটা সলিড চয়েস। এটি আপনার চেইনকে দীর্ঘসময় ভালো রাখবে, শুধু আপনাকে একটু কষ্ট করে পরিষ্কার করতে হবে।
- যদি আপনি কোনো দুর্গম এলাকায় আটকে যান এবং চেইন শুকনো হয়ে আওয়াজ করে, তবে হাতের কাছে পাওয়া ইঞ্জিন অয়েল জীবন রক্ষাকারী হতে পারে।
- কিন্তু... আপনি যদি আপনার বাইককে ভালোবাসেন, একটা স্মুথ এবং ঝামেলাবিহীন রাইড চান, বাইকের চাকা পরিষ্কার রাখতে চান এবং মডার্ন O-Ring চেইনের সর্বোচ্চ সুরক্ষা চান, তবে একটি ভালো মানের ডেডিকেটেড চেইন লুব (Chain Lube) এর বিকল্প নেই।
বাইক মাখনের মতো স্মুথ করার উপায় (The "How-To" Guide)
শুধু সেরা লুব কিনলেই হবে না, সেটা সঠিকভাবে ব্যবহার করাটাও একটা শিল্প। অনেকেই দামী লুব কিনে এনে ময়লা চেইনের ওপর স্প্রে করে দেন। বিশ্বাস করুন, এর চেয়ে খারাপ কিছু হতে পারে না। ময়লা চেইনে লুব দেওয়া আর গোসল না করে গায়ে দামী পারফিউম মারা একই কথা। ময়লাগুলো লুবের সাথে মিশে আরও শক্ত হয়ে চেইনের বারোটা বাজিয়ে দেবে। বাইক স্মুথ করার আসল রহস্য হলো: Clean first, Lube second. আসুন, ধাপে ধাপে প্রক্রিয়াটা দেখে নিই। এটি করতে আপনার লাগবে মাত্র ১৫-২০ মিনিট।
যা যা লাগবে:
- একটি চেইন ক্লিনার স্প্রে (অথবা কেরোসিন/ডিজেল)। কখনোই পেট্রোল ব্যবহার করবেন না, এটি O-Ring নষ্ট করে দেয়।
- একটি চেইন ক্লিনিং ব্রাশ (পুরোনো টুথব্রাশ দিয়েও কাজ চলবে, তবে সময় বেশি লাগবে)।
- একটি ভালো মানের চেইন লুব (Chain Lube)।
- কিছু পুরোনো কাপড়ের টুকরো (Rags)।
- এক টুকরো কার্ডবোর্ড (ঐচ্ছিক, চাকা নোংরা হওয়া থেকে বাঁচাতে)।
- বাইকটিকে মেইন স্ট্যান্ডে (ডাবল স্ট্যান্ড) দাঁড় করান। যাতে পেছনের চাকা ফ্রিতে ঘুরতে পারে। বাইক নিউট্রালে রাখুন। ইঞ্জিন বন্ধ রাখুন। সতর্কতা: ভুলেও বাইক স্টার্ট দিয়ে গিয়ারে রেখে চাকা ঘুরন্ত অবস্থায় চেইনে হাত দেবেন না। আঙুল কেটে পড়ে যাওয়ার অসংখ্য নজির আছে। সাবধান!
ধাপ ২: পরিষ্কার করা (Cleaning)
- আসল কাজ চাকার নিচে কার্ডবোর্ডটি রাখুন যাতে মেঝে নোংরা না হয়। এবার চেইন ক্লিনার বা কেরোসিন দিয়ে পুরো চেইনটি ভালোভাবে ভিজিয়ে দিন। চাকা হাত দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সব অংশে লাগান। কয়েক মিনিট অপেক্ষা করুন যাতে ময়লাগুলো নরম হয়। এবার ব্রাশ দিয়ে ঘষে ঘষে বহুদিনের জমে থাকা কালো গ্রিজ এবং মাটি তুলে ফেলুন। চেইনের সব দিক—ওপরে, নিচে, পাশে—ভালো করে ব্রাশ করুন। একটু স্পর্শক কথা বলি। এই কাজটা করার সময় আমার প্রায়ই মনে হয়, আমরা জীবনের সমস্যাগুলোও এভাবেই জমিয়ে রাখি। তারপর একদিন ঘষে তুলতে গিয়ে ঘাম ছুটে যায়। তাই নিয়মিত পরিষ্কার করাই ভালো, তাই না? যাই হোক, ব্রাশ করা হয়ে গেলে আবার ক্লিনার স্প্রে করে বা পানি দিয়ে ধুয়ে সব ময়লা ফেলে দিন। যতক্ষণ না চেইনের মেটালিক কালার দেখা যাচ্ছে, ততক্ষণ পরিষ্কার করুন।
ধাপ ৩: শুকানো (Drying)
- এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চেইন ভেজা থাকা অবস্থায় লুব দেবেন না। একটা শুকনো কাপড় দিয়ে চেইনটি ভালো করে মুছে নিন। তারপর মিনিট দশেক অপেক্ষা করুন যাতে এটি পুরোপুরি শুকিয়ে যায়। চেইনের ফাঁকে পানি বা কেরোসিন থেকে গেলে লুব ঠিকমতো কাজ করবে না।
ধাপ ৪: লুব্রিকেশন (Lubrication)-
- স্মুথনেসের শুরু এখন আপনার চেইনটি পরিষ্কার এবং শুকনো। লুব ক্যানটি ভালো করে ঝাঁকিয়ে নিন। লুব স্প্রে করার সেরা জায়গা হলো চেইনের নিচের অংশ, যেখানে চেইনটি পেছনের স্প্রোকেটে ঢুকছে। স্প্রে নজলটি চেইনের ভেতরের দিকে (রোলারের ওপর) তাক করুন। ধীরে ধীরে চাকা উল্টো দিকে ঘোরান এবং সমানভাবে লুব স্প্রে করতে থাকুন। পুরো চেইনটি একবার ভিজে গেলেই যথেষ্ট। অতিরিক্ত লুব দেওয়ার দরকার নেই। মনে রাখবেন, লুব দরকার চেইনের ভেতরের পিন এবং রোলারে, বাইরের প্লেটে নয়।
ধাপ ৫: ফিনিশিং টাচ (The Finishing Touch)
- লুব দেওয়ার পর অন্তত ১৫-২০ মিনিট অপেক্ষা করুন। এই সময়ে লুবের সলভেন্ট উড়ে যাবে এবং লুবটি ঘন হয়ে সেট হবে। সবশেষে, একটি পরিষ্কার শুকনো কাপড় দিয়ে চেইনের বাইরের অংশে লেগে থাকা অতিরিক্ত লুব আলতো করে মুছে ফেলুন। বাইরের এই অতিরিক্ত লুব কোনো কাজে লাগে না, উল্টো ধুলোবালি আকর্ষণ করে। ব্যাস! আপনার কাজ শেষ। এবার বাইক চালিয়ে দেখুন। পার্থক্যটা আপনি প্রথম গিয়ার ফেলার সাথে সাথেই অনুভব করবেন। সেই বিরক্তিকর শব্দ নেই, বাইক চলছে মাখনের মতো।
এর সুবিধাগুলো কী কী?
- Low Fling-off: এটি শুকিয়ে সেট হয়ে যাওয়ার পর সহজে ছিটকে পড়ে না। আপনার বাইকের চাকা পরিষ্কার থাকে।
- O-Ring/X-Ring Safe: এগুলো বিশেষভাবে ডিজাইন করা হয় যাতে রাবারের রিংগুলোর কোনো ক্ষতি না হয়।
- কম ময়লা টানে: বিশেষ করে "Dry Lube" ভ্যারিয়েন্টগুলো ধুলোবালি খুব কম আকর্ষণ করে।
ব্যবহার করা সহজ: জাস্ট স্প্রে করবেন। কোনো ব্রাশ, কোনো কালি মাখামাখি নেই।
কোনো অসুবিধা নেই? আছে। দাম। ইঞ্জিন অয়েল বা গিয়ার অয়েলের তুলনায় এর দাম বেশ বেশি। এবং গিয়ার অয়েলের মতো এটি হয়তো ৫০০-১০০০ কিলোমিটার টিকবে না, আপনাকে প্রতি ৩০০-৪০০ কিলোমিটারে আবার অ্যাপ্লাই করতে হতে পারে (নির্ভর করে রাইডিং কন্ডিশনের ওপর)।
তুলনা: এক নজরে (The Comparison Table)
| বৈশিষ্ট্য | ইঞ্জিন অয়েল (Engine Oil) | গিয়ার অয়েল (Gear Oil) | চেইন লুব (Chain Lube Spray) |
| স্থায়িত্ব (Longevity) | খুব কম | খুব বেশি | মাঝারি থেকে বেশি |
| ছিটকে পড়া (Fling-off) | খুব বেশি (চাকা নোংরা করে) | মাঝারি | খুব কম (সঠিকভাবে ব্যবহার করলে) |
| ময়লা আকর্ষণ (Dirt Attraction) | খুব বেশি | বেশি | কম (বিশেষ করে ড্রাই লুব) |
| ব্যবহারের সুবিধা (Ease of Use) | সহজ (কিন্তু নোংরা) | কঠিন (খুব নোংরা) | খুব সহজ (পরিচ্ছন্ন) |
| O-Ring সেফটি | মোটামুটি | ভ্যারিয়েবল (কিছু ক্ষতিকারক হতে পারে) | হ্যাঁ (বেশিরভাগই) |
| খরচ (Cost) | প্রায় বিনামূল্যে (যদি পোড়া মবিল হয়) | সস্তা | তুলনামূলক দামী |
শেষকথা: যত্নই দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্কের মূল
বাইক চালানো কেবল এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়া নয়, এটি একটি অনুভূতি। একটি প্যাশন। আর এই প্যাশনকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে বাইকের একটু যত্ন তো নিতেই হবে। আমরা অনেকেই ইঞ্জিনের পেছনে হাজার হাজার টাকা খরচ করি, দামী স্টিকার লাগাই, কিন্তু চেইনের মতো ভাইটাল পার্টকে অবহেলা করি। একটি শুকনো, জং ধরা চেইন শুধু আপনার রাইডিং এক্সপেরিয়েন্স নষ্ট করে না, এটি যেকোনো সময় ছিঁড়ে গিয়ে বড় দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। বিশেষ করে হাই স্পিডে চেইন ছিঁড়ে গেলে কী হতে পারে, তা ভাবলেই গা শিউরে ওঠে। তাই আজই আপনার বাইকের চেইনটা চেক করুন। যদি সেটা শুকনো খটখটে হয়, তবে এই উইকেন্ডেই একটু সময় বের করে ওপরের নিয়মগুলো মেনে পরিষ্কার ও লুব্রিকেট করে ফেলুন। বিশ্বাস করুন, পরেরবার যখন বাইক নিয়ে রাস্তায় নামবেন, তখন বাইকের স্মুথনেস দেখে আপনার মুখে যে হাসিটা ফুটবে, তার কোনো মূল্য হয় না।
বন্ধু, বাইকটা শুধু যানবাহন না। এটা আমাদের সাথী, ঝুঁকির সময়ে নির্ভরতার জায়গা, ভালোলাগার উৎস। আর এই সাথীর একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো সেই চেইন সেট, যেটা তোমার ইঞ্জিনের শক্তি পেছনের চাকায় পৌঁছে দেয়। এর যত্ন নেয়াটা একটা কর্তব্যের চেয়ে বেশি, একটা ভালোবাসার প্রকাশ। Chain Lube, Gear Oil, Engine Oil – এই ত্রিধারার মায়া কাটিয়ে উঠতে পারলেই তুমি একজন জ্ঞানী রাইডারে পরিণত হবে। মনে রাখবে, সঠিক লুব্রিকেন্ট, নিয়মিত পরিষ্কার, আর ঠিক সময়ে প্রয়োগ – এই তিন মন্ত্র মেনে চললে তুমি শুধু বাইককেই মসৃণ করবা না, পুরো রাইডিং এক্সপেরিয়েন্সটাই হবে অন্যরকম। কম ঝাঁকি, কম ক্লান্তি, বেশি মাইলেজ, আর সানডে মর্নিং এর সেই ছুটে চলার আনন্দে কোনো বাধা থাকবে না। লুবের ক্যানটা হাতে নেয়ার আগে একবার ভাবো – তুমি শুধু তেল দিচ্ছো না, তুমি দিচ্ছো যত্ন। দিচ্ছো সেই সম্ভাবনা, যাতে আগামীকাল আরও দূরের, আরও সুন্দর কোনো রাস্তায় নিজেকে খুঁজে পাও। রাইড সেফ। রাইড স্মুথ।
নিজে জানুন, অন্যকে জানান। আপনার রাইডিং গ্রুপের বন্ধুদের সাথে এই তথ্যগুলো শেয়ার করুন। হ্যাপি রাইডিং!
কল টু অ্যাকশন
এখনই গ্যারেজে যাও, বা তোমার বাইকের চেইনটা চেক করো। শুকনো লাগছে? নোংরা? আজই সময় করে পরিষ্কার করো, এবং একটি ভালো কোয়ালিটির চেইন লুব্রিকেন্ট প্রয়োগ করো। পরিবর্তনটা নিজেই অনুভব করবে পরের রাইডে। এই পোস্টটি যদি তোমার কাজে লাগে, তবে নিজে জানা, অন্যকে জানানো-র নীতি অনুসারে অবশ্যই শেয়ার করো তোমার রাইডার বন্ধুদের সাথে। তাদেরও উপকার হবে। নিচে কমেন্টে জানাও, তুমি কোন লুব ব্যবহার করো, আর কীভাবে তোমার অভিজ্ঞতা ছিল। রাইড অন!
আপনার বাইকে আপনি কী ধরনের লুব ব্যবহার করেন? ইঞ্জিন অয়েল, গিয়ার অয়েল নাকি চেইন লুব? আপনার অভিজ্ঞতা কেমন? কমেন্ট করে আমাদের জানান। আর এই আর্টিকেলটি যদি আপনার উপকারে আসে, তবে শেয়ার করতে ভুলবেন না। বাইক মেইনটেনেন্স নিয়ে আরও কোনো প্রশ্ন থাকলে সেটাও কমেন্টে জানাতে পারেন। আমরা উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব।
সচরাচর জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQ)
Q: ১. কতদিন পর পর চেইনে লুব দেওয়া উচিত?
- উঃ এটি নির্ভর করে আপনি কোথায় এবং কীভাবে বাইক চালান তার ওপর। সাধারণ নিয়মে, প্রতি ৪০০ থেকে ৫০০ কিলোমিটার পর পর চেইন লুব করা উচিত। তবে যদি আপনি খুব ধুলোবালিযুক্ত রাস্তায় বা বৃষ্টির মধ্যে চালান, তবে আরও ঘন ঘন (প্রতি ২০০-৩০০ কিমি) লুব করা প্রয়োজন হতে পারে। সহজ কথা হলো, যখনই চেইন শুকনো মনে হবে বা শব্দ করবে, তখনই লুব দিন।
Q: ২. চেইন পরিষ্কার করার জন্য WD-40 ব্যবহার করা যাবে কি?
- উঃ এটি নিয়ে বাইকারদের মধ্যে বিতর্ক আছে। WD-40 খুব ভালো ক্লিনার এবং এটি ময়লা দূর করতে দারুণ কার্যকর। তবে, এটি মূলত একটি সলভেন্ট বা দ্রাবক, লুব্রিকেন্ট নয়। কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এটি O-Ring-এর ভেতরের গ্রিজকে পাতলা করে বের করে দিতে পারে। তাই safest option হলো ডেডিকেটেড চেইন ক্লিনার বা কেরোসিন ব্যবহার করা। যদি WD-40 ব্যবহার করেনও, তবে পরিষ্কার করার পর অবশ্যই ভালো মানের চেইন লুব ব্যবহার করতে হবে।
Q: ৩. Wet Lube এবং Dry Lube-এর মধ্যে পার্থক্য কী?
- উঃ Wet Lube একটু বেশি তেলতেলে এবং ভেজা থাকে। এটি বর্ষাকাল বা খুব কাদাটে রাস্তার জন্য ভালো কারণ এটি সহজে পানি দিয়ে ধুয়ে যায় না। কিন্তু এটি ধুলোবালি বেশি আকর্ষণ করে। Dry Lube স্প্রে করার পর শুকিয়ে একটি মোমের মতো স্তর তৈরি করে। এটি খুব কম ধুলোবালি আকর্ষণ করে, তাই শুকনো এবং ধুলোযুক্ত আবহাওয়ার জন্য এটি সেরা। তবে এটি বৃষ্টির পানিতে দ্রুত ধুয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশের আবহাওয়ায় অনেকে ড্রাই লুব পছন্দ করেন কারণ এখানে ধুলো বেশি।
Q: ৪. নতুন বাইকের চেইনে কি লুব দিতে হয়?
- উঃ নতুন বাইকের চেইনে ফ্যাক্টরি থেকে এক ধরণের সাদা, আঠালো গ্রিজ লাগানো থাকে। এটি খুবই উন্নত মানের লুব্রিকেন্ট। প্রথম ৫০০-১০০০ কিলোমিটার (বা প্রথম সার্ভিসিং পর্যন্ত) এই গ্রিজটি রেখে দেওয়া উচিত, যদি না চেইন খুব বেশি নোংরা হয়ে যায়। এটি তুলে ফেলে নতুন করে লুব দেওয়ার দরকার নেই।
Q: ৫. পুরনো গিয়ার অয়েল চেইনে দিলে সত্যিই এত ক্ষতি হয়?
- উঃ হ্যাঁ, সত্যিই হয়। এটা জমে, গ্রিটকে (ধুলো-বালি) আটকে একটা স্যান্ডপেপারের মতো কাজ করে। দীর্ঘমেয়াদে চেইন স্ট্রেচ হয়, স্প্রকেটের দাঁত ভোঁতা হয়ে যায়। মেরামত বিল অনেক বাড়বে।
Q: ৬. চেইন কভার (O-Ring, X-Ring) আছে এমন বাইকে কি আলাদা লুব দরকার?
- উঃ অবশ্যই! সিলড চেইনের জন্য স্পেসিফিক্যালি তৈরি চেইন লুব ব্যবহার করতে হয়। এগুলো পাতলা সান্দ্রতার, যাতে O-Ring বা X-Ring-এর রাবার সীল ড্যামেজ না হয়, কিন্তু ভিতরে ঢুকতে পারে। সাধারণ লুব ব্যবহার করলে রাবার ফেটে যেতে পারে, চেইন এর জীবন কমে যাবে।
Q: ৭. চেইনে কি গ্রীস লাগানো যায়?
- উঃ সাধারণ গ্রীস (লিথিয়াম গ্রীস ইত্যাদি) একদমই না। এটা খুব ভারি, ধুলো আকর্ষণ করে, ঠান্ডায় জমে যায়। তবে চেইন গ্রীস নামে কিছু প্রোডাক্ট আছে যা উচ্চ তাপমাত্রায়ও কাজ করে, সেগুলো আলাদা।
Q: ৮. বাইক শোরুমে সাভলুব বা অন্য কিছু দেয়, সেটা কি ঠিক আছে?
- উঃ অনেক শোরুম বাজেটের কথা চিন্তা করে সাধারণ তেল ব্যবহার করতে পারে। তুমি নিজে একটি ভালো ব্র্যান্ডের চেইন লুব কিনে দিতে পারো, এবং তাদের বলতে পারো সেটাই ব্যবহার করার জন্য। এতে খরচ একটু বেশি হবে, কিন্তু বাইকের সুস্থতা নিশ্চিত।
Q:৯. চেইন থেকে আওয়াজ আসছে, লুব দিয়েও থামছে না, কেন?
- উঃ সম্ভবত চেইনটি অতিরিক্ত টেনশনে টাইট হয়ে গেছে, অথবা স্প্রকেটগুলো ক্ষয় হয়ে গেছে। অথবা, চেইনটা নিজেই তার জীবনকাল শেষ করেছে (স্ট্রেচড হয়েছে)। তখন লুব দিলেও কাজ হবে না, রিপ্লেস করতে হবে।


কাজীআরিফুল ডট কমে নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url